কাইয়ুম চৌধুরী জন্মেছিলেন ফেনীতে, ১৯৩৪ সালের ৯ মার্চ।
ক্ষয়িঞ্চু যে জমিদার-পরিবারে তাঁর
জন্ম সেখানে বিত্তের পূর্বতন জৌলুস বিশেষ অবশিষ্ট
ছিল না, কিন্তু এই পরিবারে
শিক্ষা ও উদার মানসের ছিল জোরদার অবস্থান। চৌধুরী
পরিবারের এক সদস্য আমীনুল
ইসলাম চৌধুরী লিখেছিলেন নোয়াখালীর ইতিহাস।
বিত্তের ঘাটতি ঘটলেও চিত্তের
প্রসার বহাল ছিল এবং পরিবারের অনেক সদস্যই
হয়েছিলেন শিক্ষিত পেশাজীবী। পিতা
আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী ছিলেন সমবায় পরিদর্শক এবং পরে
হয়েছিলেন সমবায় ব্যাংকের
কর্মকর্তা।
পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও পিতার সামাজিক যোগাযোগও
ছিল অনেক বিস্তৃত।
নোয়াখালীতে গোপাল হালদারের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য।
কুমিল্লায় শিক্ষিত রুচিবান
ধ্রুপদী গায়ক মোহাম্মদ হোসেন খসরু এবং লোকগানের
সাধক সুরকার শচীন দেববর্মনের
সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রামের আব্দুল
করিম সাহিত্য বিশারদের সঙ্গে
তাঁদের ছিল পারিবারিক যোগাযোগ। বাবার বদলির
চাকরির সুবাদে কাইয়ুম চৌধুরী
বাংলার অনেক এলাকায় ঘুরে ফিরেছেন।
শিক্ষাজীবন
একেবারে বাল্যে মক্তবে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি, তারপর
ভর্তি হলেন চট্টগ্রামের
নর্মাল স্কুলে। এরপর কিছুকাল কুমিল্লায় কাটিয়ে চলে
যান নড়াইলে। চিত্রা পারের এই
শান্ত স্নিগ্ধশ্রী শহরে কাটে তাঁর বাল্যের তিনটি বছর।
সেখান থেকে সন্দ্বীপ এসে
ভর্তি হন প্রথমে সন্দ্বীপ হাই স্কুলে ও পরে কারগিল
হাই স্কুলে। ততদিনে স্কুলের
কিছুটা উঁচু ক্লাসে উঠেছেন, মনের মধ্যে দানা বাঁধছে
নানা স্মৃতি। প্রত্যন্ত বাংলার
লোকায়ত জীবনে যে সমন্বিত সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ কার্যকর
ছিল তার পরিচয়বহ একটি
ঘটনা স্মরণ করে আজো আপ্লুত বোধ করেন তিনি। সবুজে
ঘেরা ছোট্ট শহরের ডাকবাংলোর
উল্টোদিকে কো-অপারেটিভ ব্যাংক এবং এর সংলগ্ন
কর্মকর্তার আবাস। পুত্রকে আরবি
ভাষায় সবক ও নামাজ শিক্ষাদানের জন্য নিযুক্ত
হয়েছিলেন গৃহশিক্ষক, যিনি সন্দ্বীপ
হাই স্কুলের মৌলবি স্যার। পরে স্কুলের বার্ষিক
পুরস্কার বিতরণী সভায় বালকের স্মৃতি
ঐশ্বর্য মণ্ডিত করে আরবি স্যার হারমোনিয়াম বাজিয়ে
গাইলেন অতুলপ্রসাদের গান,
'সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।'
এরপর নোয়াখালি সদরে কিছুকাল কাটিয়ে পিতার সঙ্গে
তাঁর ঠাঁই বদল হয় ফেনীতে।
ভর্তি হলেন ফেনী হাই স্কুলে, সেখানে থেকে যান
ফরিদপুরে। ফরিদপুর থেকে অবশেষে
ময়মনসিংহ এসে সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে যখন
ম্যাট্রিক পাশ করেন তখন ১৯৪৯ সাল,
বৃটিশ বিদায় হয়ে পাকিস্তানের জন্মের পর কেটেছে
প্রায় দু'বছর। ১৯৪৯ সালে আর্ট
ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে কাইয়ুম চৌধুরী কৃতিত্বের সঙ্গে
শিক্ষা সমাপন করেন ১৯৫৪ সালে।
শিল্পশিক্ষার পটভূমি
পিতার প্রভাব তাঁকে বিশেষ আগ্রহী করেছে সঙ্গীতে ও
গ্রন্থপাঠে। বাল্যকালে অর্জিত
এই দুই নেশা তাঁর পরবর্তী শিল্পীজীবনে বিশেষ
ছায়াপাত ঘটিয়েছে। বাড়িতে ছিল
বইপত্রের বিশাল ভাণ্ডার। তাছাড়া ডাকযোগে
নিয়মিত-প্রাপ্ত বাংলা সাময়িকীর সংগ্রহ
ছিল সমৃদ্ধ। 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'মানসী' ও
'মর্ম্মবাণী',
'বঙ্গশ্রী' তো ছিলই, এমনকি
বঙ্কিমচন্দ্র সম্পাদিত 'বঙ্গদর্শন''-এর পুরনো অনেক সংখ্যাও
ছিল পারিবারিক সংগ্রহে।
সেকালের রুচিশীল গৃহের পরিচায়ক হিসেবে আরও ছিল
কলের গান এবং গ্রামোফোন
রেকর্ডের সংগ্রহ। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরে তখন বড় আসন
দখল করেছিল সাহিত্য সাময়িকী
ও মিনিট-প্রতি ৭৮ ঘূর্ণনের রেকর্ড। মাসিক সাহিত্য
পত্রগুলো মুদ্রণ কৌশলের অগ্রগতির
সুযোগ নিয়ে ফটোগ্রাফ এবং চিত্রকলার প্রতিলিপি
নিয়মিতভাবে ছাপত। গ্রামোফোন
রেকর্ডে গানকে বন্দি করার কৌশলের অভিনবত্ব বাংলা
সঙ্গীতজগতে এক প্রবল জাগরণ
সৃষ্টি করেছিল। যান্ত্রিক পুনরুত্পাদনের এই দুই পদ্ধতি
শিল্পের রস পৌঁছে দিতে সক্ষম
হয়েছিল প্রত্যক্ষ দর্শক কিংবা শ্রোতামণ্ডলীর বাইরে
অপ্রত্যক্ষ স্তরে বৃহত্তর জনসমাজে।
এমনি পারিবারিক প্রভাবে স্নাত হয়ে বাল্যকালে,
চিত্তবিকাশের সুযোগ গ্রহণ
করেছিলেন কাইয়ুব চৌধুরী।
স্কুল জীবন থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ঝোঁক দেখা গিয়েছিল
কাইয়ুম চৌধুরীর। তখনকার দিনে
আঁকাআঁকি শেখার জন্য যেতে হত কলকাতায়, কিন্তু সে তো
পরিবারের সামর্থ্যের বাইরে।
শুনেছেন ঢাকায় নাকি শিল্পশিক্ষালয় খোলা হয়েছে এবং
এই কাজের প্রধান কুশীলব
ময়মনসিংহের কৃতী সন্তান জয়নুল আবেদিন। একদিন জয়নুল
আবেদিনকে দেখেও ফেললেন।
সেই প্রথম দেখা, ছুটি কাটাতে দেশে আসা জয়নুল আকুয়ার
পুকুর ঘাটে স্নান করছিলেন।
পুত্রের আগ্রহে বাবা জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আলোচনা
করলেন ঢাকার আর্টস ইনস্টিটিউটে
ভর্তির বিষয়ে এবং পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্বেই
১৯৪৯ সালের শেষাশেষি কাইয়ুম
চৌধুরী ঢাকায় এসে অপরিসর দুই কক্ষের সেই
প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেন। পরবর্তী
ইতিহাস সহজেই অনুমেয়। যাঁরা এখানে শিক্ষকতার দায়
নিয়েছিলেন তাঁরা অন্তরে বহন
করছিলেন কলকাতার উপমহাদেশীয় শিল্পচর্চার পীঠস্থান
থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং
সম্পদের দীনতা সত্ত্বেও শিক্ষামানে কোনও আপোস করতে
প্রস্তুত ছিলেন না। অপরদিকে
যাত্রাকালে যাঁরা শিক্ষার্থী হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত
করেছিলেন তাঁদের কারও
সামনেই শিল্পচর্চার কোনও বাস্তব দৃষ্টান্ত উপস্থিত ছিল
না। এমনকি প্রথম সাক্ষাতে
জয়নুল আবেদিন যখন চাইনিজ ইঙ্ক নিয়ে ক্লাসে আসতে
বললেন তখন বিস্মিত কাইয়ুম
চৌধুরী জানতে চাইছিলেন চাইনিজ ইঙ্ক কি। ডাঙ্কি
কাকে বলে সেটিও ক্লাসে ঢুকে
প্রথম চিনতে পারলেন।
ঢাকায় এসে বোনের বাসায় উঠেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী,
বাবার দেয়া মাসোহারা ছিল
চার টাকা। সতীর্থ অন্যরাও মধ্যবিত্ত বলয়ের মানুষ।
জেলা শহর ঢাকা হঠাত্ করে
প্রাদেশিক রাজধানী হয়েছে বটে কিন্তু নাগরিক আচার
বা বৈদগ্ধ তখনও কিছু আয়ত্ত
হয়নি। দ্রুত বাড়ছিল শহর, তবে শহরের মানুষের সঙ্গে
গ্রামবাংলার যোগ ছিল বেশ
নিবিড়। বস্তুত গোটা পূর্ববঙ্গেই শহুরে এলিট শ্রেণী
বিশেষ বলবান ছিল না। পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মধ্যেই যে বাংলা ভাষার অধিকার
ঘিরে উত্তেজনা ও আন্দোলনের
স্ফূরণ দেখা দেয় সেটি পূর্ববঙ্গবাসীর এই সমাজসম্পৃক্ত
সাংস্কৃতিক চেতনারই অভিব্যক্তি।
বড় আকারের স্বপ্ন বুকে নিয়ে ছোট আকারে যে যাত্রা শুরু
হয়েছিল আর্টস ইনস্টিটিউটের
তা ক্রমশ কাঠামোগতভাবে বিকশিত হতে থাকে। ১৯৫২
সালের শেষাশেষি সেগুনবাগিচায়
বাগান ও মাঠসমেত বনেদি দোতলা ভবনে ইনস্টিটিউট
স্থানান্তরিত হয়। এরপর শুরু হয়
নিজস্ব ভবন নির্মাণের প্রয়াস এবং ১৯৫৬ সালে
প্রতিভাবান তরুণ স্থপতি মাজহারুল
ইসলামের নকশায় তত্কালীন ঢাকার আধুনিক স্থাপত্যের
শ্রেষ্ঠ নিদর্শনস্বরূপ বর্তমান
ভবন নির্মিত হয়ে এর স্থায়ী রূপদান সম্পন্ন হয়।
এসব তো ছিল অবকাঠামোগত দিক। অন্তরকাঠামো নির্মাণে
জয়নুল আবেদিন-কামরুল
হাসানের লোকায়তিক দৃষ্টি, সফিউদ্দিন আহমদের
বিশুদ্ধবাদিতা এবং গোটা
শিক্ষকমণ্ডলীর দক্ষতা ও নিষ্ঠা ছাত্রদের মধ্যে
বিপুলভাবে প্রেরণাসঞ্চারী হয়েছিল।
শিল্পক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের পরিবর্তনময় পর্ব
সেই সময় ঢাকা একদিকে পাকিস্তানের পূর্ব প্রদেশের
রাজধানী হয়েছিল, অপরদিকে একে
প্রাদেশিকতাদুষ্ট করার আয়োজনও ছিল প্রবল। এই সঙ্কীর্ণ
মানসবৃত্ত থেকে মুক্তির জন্য
আনন্দপথ ছিল বাল্যে অর্জিত দুই শখ- গ্রন্থপাঠ ও
সঙ্গীতশ্রবণ। এই দুই উপায় বেশ
সহজেই লভ্য ছিল এবং নগরীতে এসে সেইসঙ্গে তিনি
মজলেন চলচ্চিত্রে। তত্কালীন
ঢাকার নবীন শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যপথিক
ছাত্র, চলচ্চিত্রপ্রেমী,
সঙ্গীতগুণী সকলের সঙ্গে সকলের এক অবাধ যোগাযোগ
ছিল। আর্টস ইনস্টিটিউটের
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমগ্র শিল্পজগতের এমনি মিল
রচনায় জয়নুল আবেদিনও ছিলেন
বিশেষ যত্নশীল। তিনি জসীমউদ্দীন, শামসুদ্দিন আবুল
কালাম, কানাইলাল শীল, মমতাজ
আলী খান বা আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর ছাত্রদের
পরিচয় ঘটিয়েছিলেন। ঢাকা আর্ট
গ্রুপ গঠন করে তিনি এতে যুক্ত করেছিলেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিদগ্ধজনদের। আর
ছাত্ররা সেতুবন্ধ গড়েছিল হাসান হাফিজুর রহমান,
শামসুর রাহমান, ফজলে লোহানী,
জহির রায়হান, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, আলতাফ মাহমুদ
আনিসুজ্জামান প্রমুখ নবীনদের
সঙ্গে। উদার সংস্কৃতির মিলনের আবহ তাই নবীন-প্রবীণ
উভয় দিক দিয়েই ছিল কার্যকর।
এরই মধ্যে ১৯৫১ সালে, যখনও শিক্ষার্থীরা শিল্পের
তালিম গ্রহণে সিদ্ধ হয়ে উঠতে
পারেননি, আয়োজিত হয় ঢাকা আর্ট গ্রুপের প্রথম
প্রদর্শনীর। কার্যত এটি ছিল আর্টস
ইনস্টিটিউটের বার্ষিক প্রদর্শনী। ঢাকার মতো, মফস্বলী
শহরকে নাগরিকতায় পুষ্ট করতে
এ ছিল পথিকৃত্ আয়োজন এবং বেশ অভিনবও বটে। কার্জন
হলের পেছনকার লিটন হলে
আয়োজিত এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল মূলত শিক্ষকদের
ছবি এবং সেই সঙ্গে নবিশ
ছাত্রদের কাজ। কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণ করতে পারেন এই
প্রদর্শনীতে টিকিট প্রদর্শনীতে
টিকিট কেটে প্রবেশের বিধান রাখা হয়েছিল এবং দর্শক
সমাগম হয়েছিল প্রচুর। এরপর
আয়োজিত ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় বার্ষিক প্রদর্শনীর
উদ্বোধনের দিন ধার্য হয়েছিল
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। স্থান নির্ধারিত হয়েছিল
নিমতলিস্থ ঢাকা জাদুঘর। নলিনীকান্ত
ভট্টশালীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত যে জাদুঘর
পূর্ববঙ্গে শিল্প ও পুরাকীর্তি
নিদর্শনের সংগ্রহশালার অভাব কিছুটা মিটিয়েছিল।
এমনি জাদুঘরের অপর এক সমৃদ্ধ
নিদর্শন ছিল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রতিষ্ঠিত রাজশাহীর
বরেন্দ্র মিউজিয়াম। দেশভাগের
ফলে পূর্ব প্রদেশে এই দুই প্রতিষ্ঠান ছিল জাদুঘরের
সবেধন ক্ষীণকায় উপস্থিতি।
তুলনামূলকভাবে লাহোর ছিল অনেক সৌভাগ্যবান, উনিশ
শতকে প্রতিষ্ঠিত লাহোর
মিউজিয়াম গান্ধারা, গুপ্ত যুগ, মোঘল আমলের নানা
নিদর্শনে সমৃদ্ধ এবং মেয়ো কলেজ
অব আর্টস-এর সঙ্গে মিলিতভাবে সক্রিয় ছিল কলকাতা
আর্ট স্কুলের সঙ্গেও ভারতীয়
জাদুঘরের ছিল নিবিড় সম্পর্ক। সজ্জন ব্যক্তিত্ব পাঞ্জাবি
ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান
দানী তখন ঢাকা জাদুঘরের পরিচালক এবং তাঁর সঙ্গে
জয়নুল আবেদিনের সুসম্পর্ক ছিল।
ঢাকা জাদুঘরের কক্ষের ভারি ভারি মূর্তি সরিয়ে স্থান
করা হয়েছিল প্রদর্শনীর। কথা
ছিল গভর্নরের ইতালীয় পত্নী মিসেস ভিকারুন্নেসা নূন
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন।
কিন্তু আগের দিন একুশে ফেব্রুয়ারির ছাত্র মিছিলে
পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার
প্রতিবাদে সেই আয়োজন পরিত্যক্ত হয়। সদ্য-প্রতিষ্ঠিত
আর্টস ইনস্টিটিউটের নবীন
শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন
করেন। ইমদাদ হোসেন, মুর্তজা
বশীর, আমিনুল ইসলাম, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখ ছিলেন
প্রতিবাদী আয়োজনের নিরলস
কর্মী এবং সকল মিছিলের পুরোভাগে। অন্তর্মুখী স্বভাবের
কাইয়ুম চৌধুরীর সম্পৃক্তি ছিল
তাঁর স্বভাবসুলভ। সতীর্থদের সঙ্গে মিলে তিনিও
আন্দোলনে শরিক, তবে ভ্যানগার্ডদের
কেউ নন।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ঢাকার শিল্প শিক্ষালয়ের
ছাত্রদলের সামাজিক সম্পৃক্ততা ও
রাজনৈতিক অবস্থান যেন নিয়তি-নির্দিষ্ট করে দিল।
সরকারি আনুকূল্য-নির্ভর
প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পক্ষে জনতার কাতারে এসে
দাঁড়ানো কোনোভাবে সম্ভব ছিল না;
কিন্তু সর্বাংশে ছাত্রদের সম্পৃক্তি ও সক্রিয়তা থেকে
বোঝা যায় শিক্ষকদের সমর্থন
কোনদিকে রয়েছে।
১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী স্মরণে
রেখে হাসান হাফিজুর রহমান ও
মোহাম্মদ সুলতানের যৌথ উদ্যোগে যে সঙ্কলন প্রকাশের
প্রয়াস নেয়া হয় সেখানে নবীন
শিল্পশিক্ষার্থীদের ঘনিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। সঙ্কলনের জন্য
লিনোকাট ও ড্রইং করেছিলেন
মুর্তজা বশীর ও বিজন চৌধুরী। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন
আমিনুল ইসলাম। আর সদরঘাট থেকে
যে মিছিল বের হয়েছিল তাতে আর্ট ইনস্টিটিউটের
শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলেন
চিত্রিত ফেস্টুন নিয়ে এবং মিছিলের পুরোভাগে রশীদ
চৌধুরী, মুর্তজা বশীরের সঙ্গে
ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
শিক্ষার্থী জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে এক
সাক্ষাত্কারে কাইয়ুম চৌধুরী
বলেছিলেন: 'আমি আমার শিল্পী জীবন যখন শুরু করি
আমার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন কবি,
শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক এদের সবার মধ্যে একটা
যোগযোগ ছিল। যেমন, আমার
বন্ধুস্থানীয়দের মধ্যে আমার খুব ঘনিষ্টতম বন্ধু-যার
সঙ্গে আমি একই সঙ্গে রাতও
কাটিয়েছি, তিনি সৈয়দ শামসুল হক। তারপর শামসুর
রাহমান, আলাউদ্দিন আল-আজাদ,
হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান
জাহাঙ্গীর। আমরা এক সময় একই সঙ্গে
কাজ করতাম। সেই সময় গায়কদের মধ্যে যেমন আবদুল
আলীম সাহেবকে দেখেছি যে, কবি
জসীম উদ্দিন তাঁকে গান শেখাচ্ছেন। জসীম উদ্দিন
সাহেব তাঁর ভাঙা গলায় সুর তুলে
দিচ্ছেন আবদুল আলীমের গলায়, নীনা হামিদের গলায়,
এগুলো তো আমাদের চোখের সামনে
দেখা। মিউজিশিয়ানদের মধ্যে, আজকে যেমন সমর দাস,
আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।'
(সাপ্তাহিক ২০০০, ২২ অক্টোবর ১৯৯৯, পৃ. ৪৭)"
ঢাকার আর্টস ইনস্টিটিউটে শিল্পের করণ-কৌশল
শেখানোর মান সন্তোষজনক হলেও
চিত্রকলার ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়ে পড়াবার কোনও ক্লাস
ছিল না সে-সময়। শিল্পতত্ত্ব
বিষয় হিসেবে যেমন সংহতি অর্জন করেনি, তেমনি এ-
বিষয়ে শিক্ষাদানর যোগ্য
ব্যক্তিরও অভাব ছিল। ছাত্রদের সামনে সুযোগও ছিল
সীমিত। দুই কক্ষের শিক্ষালয়ে
বইয়েরও কোনও ভাণ্ডার ছিল না সঙ্গতকারণেই। তবে
সম্পদ ও অবকাঠামোর এই ঘাটতি
পূরণের তাগিদ শিক্ষার্থীদের মধ্যেই ছিল। কাইয়ুম
চৌধুরী বলেছেন, 'মনে আছে আমি
প্রথম যখন স্কলারশিপ পেলাম ৩৬ টাকা, এ সময়
আরমানিটোলায় একটা বইয়ের দোকান
ছিল, ওয়ার্সি বুক সেন্টার। তারা শুধু বই বিক্রি করত
না, পেইন্টিং ম্যাটেরিয়ালও
বিক্রি করত। সে সময়ে ওটাই ছিল আর্টিস্টদের একমাত্র
ম্যাটেরিয়াল কেনার দোকান।
আমি যখন ৩৬ টাকা স্কলারশিপ পেলাম এর মধ্যে ২০
টাকার বই কিনেছি। আর ১৫ টাকার
কিনেছি পেইন্টিং ম্যাটেরিয়াল।'
পূর্ববাংলায় প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার আয়োজন যে
পটভূমিকায় শুরু হয়েছিল তার
সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকগুলো শিল্পীদের চরিত্রে এক
ধরনের ঋজুত্ব সঞ্চার করেছিল এবং
একটি নবীন দেশে শত প্রতিকূলতার বাধা ঠেলে আপন
সত্তা প্রতিষ্টার যে জাতিগত
তাগিদ তার সঙ্গে ব্যক্তিগত শিল্পসত্তা বিকাশের তাগিদ
সাযুজ্যপূর্ণ ও সম্পর্কিত হয়ে
পড়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় নবীন লেখক, শিক্ষাব্রতী,
চলচ্চিত্রকার, গায়ক, সংস্কৃতিসেবী
সকলের এক সৌভ্রাতৃত্বের মধ্য দিয়ে এর যূথবদ্ধ রূপ ফুটে
উঠছিল। পঞ্চাশের দশকের
গোড়ায় পূর্ববঙ্গের এই বাস্তবতা শিল্পীদের
সমাজসংলগ্নতা যেমন গভীর করেছে, তেমনি
ঢাকার আকারে ক্ষুদ্র ইনস্টিটিউট অভ আর্টসকে তাত্পর্যে
এক বিশালতা যুগিয়েছে।
কর্মজীবন
১৯৫৪ সালে কাইয়ুম চৌধুরী যখন ফাইন আর্টস বিভাগের
পাঠ সমাপন করলেন তখন তাঁর
বয়স মাত্র কুড়ি। নবগঠিত আর্ট কলেজে যেসব ছাত্র ভর্তি
হয়েছিলেন তাঁদের কারো
সামনে পেশার ছবি পরিষ্কার কিছু ছিল না,
সে ভাবনাতে তাঁরা তেমন আলোড়িতও হননি। তাঁদের
একমাত্র অভিলাষ ছিল শিল্পী হয়ে ওঠা।
বলার অপেক্ষা রাখেনা, আর্ট
কলেজের শিক্ষা কাউকে শিল্পী করে তোলে না, শিল্পী
হওয়ার যাত্রাপথে দাঁড় করিয়ে
দেয় মাত্র। পাশ করার পর কাইয়ুম চৌধুরী তক্ষনি কোনও
পেশায় যোগ দেননি।
১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি নানা ধরনের ব্যবহারিক কাজ
করেছেন, বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে
যুক্ত থেকেছেন, আর করেছেন বইয়ের প্রচ্ছদ ও
সচিত্রকরণের কাজ। ছাত্রজীবনে
ডিজাইনের যে পারিপার্ট ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য সেটি
তিনি বাস্তবে প্রয়োগ করতে শুরু
করলেন এবং শিক্ষাসমাপন পরবর্তী হলেও এই পর্বকে
শিক্ষানবিশীর কালই বলা যায়।
তবে প্রচ্ছদ অঙ্কনে তাঁর সুবিধা ছিল তাঁর পঠনপাঠন ও
সাহিত্যবোধের ব্যাপ্তি, বইয়ের
অন্তর্নিহিত ভাব অবলম্বন করে তিনি পৌঁছতে পারেন
বহিরঙ্গে। বইয়ের প্রচ্ছদকে
শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সত্যজিত্ রায়ের
শৈল্পিক স্পর্শ তখন পল্লবিত
হতে শুরু করেছে সিগনেট প্রেসের প্রকাশনাকে ঘিরে।
পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে
সত্যজিত্ রায় সিগনেটের প্রকাশনার শিল্পনির্দেশনার
কাজ শুরু করেন এবং কেবল প্রচ্ছদ
অঙ্কনই নয়, পেছনের মলাটের লিপিবিন্যাস, নামপত্র,
পৃষ্টাসজ্জা, বাঁধাই ইত্যাদি
মিলিয়ে প্রকাশনাকে একটি সামগ্রিক শিল্পরুচির বাহক
করে তোলেন। ঢাকায় সিগনেটের
বই মোটামুটিভাবে ছিল লভ্য। কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য
এ ছিল এক অনুপম নির্দশন। তবে
পূর্ববঙ্গে প্রকাশনার তখন সবে সূচনাকাল, পাঠ্যবইয়ের
বাইরের সৃজনশীল বইয়ের
প্রকাশনা যেমন কম তেমনি মুদ্রণ পদ্ধতি ও রঙ্গিন
প্রচ্ছদ ছাপার রীতিও একান্ত
সেকেলে। ধীরে ধীরে সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির
পরিবর্তন ঘটছিল এবং চুয়ান্নর
প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি
ঘটিয়ে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এ
উত্সাহব্যঞ্জক অবস্থার জন্ম দিয়েছিল। বাঙালি
জাতীয়তাবাদের জাগরণ বাংলা সাহিত্য
ও প্রকাশনায় প্রেরণা যোগাচ্ছিল। সাময়িক পত্রিকা
বিষয়ে আগ্রহী কাইয়ুম চৌধুরী,
'ছায়াছবি' নামে একটি চলচ্চিত্র সাময়িকী যুগ্মভাবে
সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল।
সুযোগমতো টুকটাক প্রচ্ছদ আঁকছিলেন এবং এই কাজের
সূত্রেই পরিচয় সৈয়দ শামসুল হকের
সঙ্গে। ১৯৫৫ সালে তাঁর দুই বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন,
কিন্তু প্রকাশক অপারগ হওয়ায়
সে বই আর আলোর মুখ দেখেনি। প্রচ্ছদে একটি পালাবদল
তিনি ঘটালেন ১৯৫৭ সালে
প্রকাশিত জহুরুল হকের 'সাত-সাঁতার' গ্রন্থে। এতোকাল
প্রচ্ছদকে নিছক দৃষ্টিশোভন করার
যে চেষ্টা দেখা যেতো সেখানে তিনি যোগ করলেন
বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনা। অর্থাত্
গ্রন্থের বক্তব্যের বা সারসত্যের প্রতিফলন ঘটালেন
প্রচ্ছদে, একই সঙ্গে গ্রাফিক
ডিজাইনে কুশলতা ও নতুন ভাবনার ছাপ মেলে ধরলেন।
এমনি দক্ষতার যুগল মিলনে
আঁকলেন ফজলে লোহানী রচিত 'কথাসরিত্সাগর'-এর
প্রচ্ছদ যা কখনও আলোর মুখ দেখেনি
প্রকাশকের নিরুত্সাহে। প্রকাশনার ব্যাপ্তি যতো
প্রসারিত হতে লাগলো আপন দক্ষতাকে
ততো নিপুণ ও ব্যতিক্রমী করে তুলতে লাগলেন তিনি।
বন্ধুবর গাজী শাহাবুদ্দিন আহমদের
সচিত্র 'সন্ধানী' পত্রিকার আত্মপ্রকাশ তাঁর অঙ্কন,
টাইপোগ্রাফিবোধ ও রসসিঞ্চিত তির্যক
রচনা প্রকাশের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল অনবদ্য। তাঁর
ডিজাইনে প্রতিফলিত হচ্ছিল এক
আস্থার ভাব, কি করবেন সে বিষয়ে তিনি যেন অনেকটাই
নিশ্চিত।
একই নিশ্চিতি ভাবটা তাঁর সৃজনশীল কাজে তখনও ফুটে
ওঠেনি, বরং সেখানে ছিল যেন
দ্বিধা ও খুঁজে বেড়ানোর ভাব। ব্যবহারিক শিল্পের
পাশাপাশি চলছিল ছবি আঁকার
প্রয়াস, সদ্য শিক্ষাসমাপনকারী তরুনের ক্ষেত্রে যা হয়,
প্রভাব থেকে যায়
অ্যাকাডেমিক ধাঁচের, পাশাপাশি চলে নিজস্ব শিল্পরূপ
অর্জনের সাধনা। ১৯৫৪ সালে
তিনি অংশ নেন বর্ধমান ভবনে আয়োজিত নিখিল
পাকিস্তান চিত্রপ্রদর্শনীতে। ১৯৫৬
সালে সহশিল্পী মুর্তজা বশীর ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে
নিয়ে গড়ে তোলেন 'পেইন্টার্স
ইউনিট'। ঢাকা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত হয় পেইন্টার্স
ইউনিট -এর প্রথম চিত্র
প্রদর্শনী। তিন শিল্পীর সম্মিলিত এই গ্রুপের এটিই ছিল
প্রথম ও শেষ প্রদর্শনী এবং
অচিরে নবগঠিত দল ভেঙে যায়। কাইয়ুম চৌধুরী ছয়টি
জলরঙ নিয়ে প্রদর্শনীতে যোগ
দিয়েছিলেন এবং বন্ধু সৈয়দ শামসুল হক ১৯৬২ সালের
জানুয়ারিতে 'কাইয়ুম: এ পোট্রেট'
শিরোনামে অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এই
প্রদর্শনীর বিশেষ উল্লেখ
করেছেন। লেখাটি নানা কারণে আলাদাভাবে উল্লেখের
দাবি রাখে। কাইয়ুম
চৌধুরী-বিষয়ক এটিই যে প্রথম পূর্ণাঙ্গ রচনা কেবল তা
নয়, শিল্প-সমালোচক হিসেবে
সৈয়দ শামসুল হক যে কী অসাধারণ দক্ষতা ও অন্তর্দৃষ্টি
ধারণ করতেন তার পরিচয় মেলে
এই লেখায়। সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, "কাইয়ুম আধ
ডজন জলরং ছবি নিয়ে প্রদর্শনীতে
অংশগ্রহণ করে। এর তিনটির বিষয় আমার মনে স্থায়ী
ছাপ ফেলেছে, রাতের জিন্নাহ
এভিনিউ, দুপুরে একই রাস্তা এবং ঘাটে-বাঁধা নৌকা।
সবগুলোই ছিল ঘনিষ্ঠ অবলোকন।
তিনি ছবিতে পুরে দিয়েছিলেন জলরঙের প্রয়োজনীয়
গীতলতা। কাজটি প্রশংসনীয়, কেননা
প্রকৃতিগতভাবে এই মাধ্যমটি ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ এড়িয়ে
যেতে চায়।"
এই সময়ের আঁকা আরও যে দু-একটি চিত্রকর্ম আমরা দেখতে
পাই তার মধ্যে রয়েছে
তেলরঙে 'আমার বোন', যা ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পরীতি
যাচাই করে দেখার প্রয়াস হিসেবে
গণ্য হতে পারে। আরও রয়েছে ১৯৫৬ সালে তেলরঙে আঁকা
'মহাজন' এবং একই বছর করা
জলরঙের ছবি 'নিশ্চল নৌকা'। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে
শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত
কাইয়ুম চৌধুরীর প্রথম চিত্র প্রদর্শনীতে ছবিগুলো স্থান
পেয়েছিল। 'মহাজন' এবং
'নিশ্চল নৌকা' ইঙ্গিত দেয় শিল্পীর সামনের দুই
পথের। প্রথমটিতে রয়েছে
ফিগারেটিভ কাজকে আধুনিক ফর্মে উপস্থাপনের সফল
নিরীক্ষাময়তা এবং দ্বিতীয়টিতে
লোকায়ত ফর্মের গভীরে প্রবেশের আকুতি। ১৯৫৭ সালে
কাইয়ুম চৌধুরী আর্ট কলেজে
শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি
চলছিল তাঁর ডিজাইন ও প্রচ্ছদ
অঙ্কনের কাজ। তত্কালীন প্রকাশনা পরিস্থিতিতে খুব
বেশি কাজ হওয়ার সুযোগ অবশ্য
ছিল না, কিন্তু নানা দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন।
জহির রায়হান, সৈয়দ শামসুল
হক, গাজী শাহাবুদ্দিন প্রমুখ বন্ধুদের টানে চলচ্চিত্র,
সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশনা
নিয়ে গভীরভাবে মজেছিলেন। সঙ্গীতের রসগ্রহণ তো
বরাবরের মতো চলছিল। সব মিলিয়ে
বলা যায়, শিল্পের সমগ্রতার রস আহরণ করছিলেন
যৌবনের দীপ্ত দিনগুলোতে এবং সেই
সমগ্র দৃষ্টি নিয়ে খুঁজছিলেন নিজের জন্য শিল্পভূমি।
অনুভূতিতে শিল্প
পেইন্টার্স ইউনিটের প্রদর্শনী-পরবর্তী সময়কে কাইয়ুম
চৌধুরীর শৈল্পিক মানসের এক
সঙ্কটকাল হিসেবে উল্লেখ করেছেন সৈয়দ শামসুল হক। এ
মূলত শিল্পীর মানস-সঙ্কট,
শৈল্পিক আকুতির প্রকাশপথ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দীর্ণ
হওয়ার সঙ্কট। কাইয়ুম চৌধুরী
যে ধরনের কাজ করছিলেন তাতে তৃপ্ত হতে পারছিলেন
না, হাতড়ে ফিরছিলেন বিভিন্ন
দিক; কিন্তু নিজের পথ কোনটি হবে তার সায় মন থেকে
পাচ্ছিলেন না। এসব ক্ষেত্রে
যেমনটা হয়ে থাকে, দীর্ঘ সময় তিনি হয়ে রইলেন প্রায়
নিষ্ফলা। তবে নিষ্ফলা হলেও
অকর্ষিত থাকেনি মনোভূমি। তাঁর নিজস্ব উপায়ে
শিল্পানুসন্ধান ও শিল্পজিজ্ঞাসা অব্যাহত
ছিল।
১৯৫৭ সালে সতীর্থ আমিনুল ইসলাম ও সৈয়দ জাহাঙ্গীরকে
নিয়ে কাইয়ুম চৌধুরী
গিয়েছিলেন কলকাতায়। ঢাকাস্থ বৃটিশ কাউন্সিলের তরুণ
কর্মকর্তা জিওফ্রে হেডলির
সঙ্গে তাঁদের বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছিল। ঐ কর্মকর্তা
পরে কলকাতা বদলি হলে তাঁরই
আহ্বানে এই সফর। কলকাতায় দেখা করেছিলেন তাঁর
মানস-নৈকট্যবান সত্যজিত্ রায় ও
খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে। প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ-সৌকর্য
বিকাশে তিনি নিজে যে-ধরনের আকুতি
অনুভব করছিলেন তার সমর্থন যেন মিললো এই সাক্ষাত্
থেকে। আরও ছিল চলচ্চিত্র-দর্শন
ও বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা। মোটের
ওপর বলা যায়, এই সফর থেকে
তিনি চিত্তের খোরাক সংগ্রহ করেছিলেন।
ব্যবহারিক শিল্প সংক্রান্ত কাজে কাইয়ুম চৌধুরী আনন্দ
খুঁজে পাচ্ছিলেন। ডিজাইনের যে
আঁটসাঁট চারিত্র, অবয়ব থেকে রূপে পৌঁছাবার যে
চ্যালেঞ্জ সেটি তো শিল্পের
করণকৌশলের অন্তর্গত। শিল্প-সমাধান অর্জনের ক্ষেত্রে
ব্যবহারিক ও সৃজনশীল উভয়ের
মধ্যে এক্ষেত্রে সাযুজ্য রয়েছে এবং এইসব কাজে তিনি
যেন নিজের শিল্পক্ষমতা যাচাই
ও ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন। বিশেষভাবে
তাঁর স্ফূর্তি ছিল বইরের প্রচ্ছদ
অঙ্কনে এবং এই কাজে তিনি অচিরেই এক অতুলনীয় মাত্রা
অর্জন করলেন। তরুণ এই
শিল্পীর অনুপম দক্ষতার সাক্ষ্য ফুটে উঠতে লাগলো একের
পর এক অভিনব দৃষ্টিনন্দন ভাবুক
প্রচ্ছদ শোভিত বইয়ে। ১৯৫৯ সালে বন্ধুবর গাজী
শাহাবুদ্দিন আহমদের সন্ধানী প্রকাশনী
যাত্রা শুরু করলো জহির রায়হানের 'শেষ বিকেলের
মেয়ে' গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে।
১৯৬১ সালে মাওলা ব্রাদার্স সৃজনশীল প্রকাশনার অধ্যায়
উন্মোচন শুরু করে আবদুশ
শাকুরের 'ক্ষীয়মাণ' এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যগ্রন্থ
'একদা এক রাজ্যে' প্রকাশ
দ্বারা। এই দুই প্রকাশনা সংস্থার রুচিশীল কাজের
পেছনে বরাবরই তিনি সক্রিয়
থেকেছেন। ইতোমধ্যে ১৯৫৯ সাল বার্ডস অ্যান্ড বুকস
প্রকাশ করেছিল শামসুর রাহমানের
প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে' এবং
রুচি ও ভাবনার সাযুজ্যে সেই
বইয়ের অনুপম প্রচ্ছদ আঁকলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
তত্কালীন পূর্বঙ্গে রেলওয়ে দপ্তর ছিল বৃহত্তম সরকারি
সংস্থা এবং রেলের টাইমটেবিল
ব্যাপকভাবে ব্যবহার্য বিশিষ্ট প্রকাশনা। ষান্মাসিক
টাইমটেবিলের প্রচ্ছদ নকশা নিয়ে
প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়
অধিকারীকে অর্থমূল্য পুরস্কার
প্রদান করা হতো। তত্কালীন বিচারে এই পুরস্কারের
আর্থিক ও সামাজিক মান ছিল
উঁচুদরের। ১৯৫৯ এবং ১৯৬১ সালে রেলওয়ে টাইমটেবিলের
প্রচ্ছদ এঁকে সেরা পুরস্কারটি
লাভ করেন কাইয়ুম চৌধুরী।
১৯৫৭ সালে যখন আর্ট কলেজে শিক্ষকতায় যোগ দেন তখন
জয়নুলের এই প্রতিষ্ঠানে
ছাত্রীদের পদচারণা শুরু হয়েছে। ১৯৫৪ সালে প্রথম যে
চারজন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিরেন
তাঁদের মধ্যে ছিলেন তাহেরা খানম। ১৯৬০ সালে
তাহেরা খানমের সঙ্গে পরিণয় বন্ধনে
আবদ্ধ হলেন কাইয়ুম চৌধুরী। মনের সাযুজ্য তাঁর শৈল্পিক
প্রয়াসের জন্য বিশেষ অনুকূল
হয়েছে এবং স্ত্রীর প্রেরণাদায়ক ভূমিকা সৃষ্টিশীল কর্মে
উদ্বুদ্ধ করেছে। ঐ বছরই আর্ট
কলেজ ছেড়ে যোগ দিলেন কামরুল হাসানের নেতৃত্বে
নবগঠিত ডিজাইন সেন্টারে। জয়নুল
আবেদিনের ইচ্ছে ছিল ডিজাইন সেন্টার আর্ট কলেজের
সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক। কিন্তু তা না
ঘটাতে জয়নুল-কামরুল বিরোধের আভাস দেখা দেয়। কাইয়ুম
চৌধুরী ভাবগতভাবে দুই
শিক্ষকেরই অনুরাগী, পারস্পরিক শিল্প-ঈর্ষা কিংবা
বিরোধাভাস যা-ই থাকুক উভয়ের
প্রতি সমভাবে শ্রদ্ধা পোষণ ও সম্পর্ক তিনি বজায়
রাখতে পেরেছিলেন।
১৯৬১ সালে ডিজাইন সেন্টার ছেড়ে অবজাভার হাউজে
চিফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান
করেন। 'অবজারভার' তখন মতিঝিলে নিজস্ব ভবনে আধুনিক
সংবাদপত্রের রূপায়ণ সূচিত
করেছে। ইংরেজি দৈনিক ছাড়াও সিনে-সাপ্তাহিক
'চিত্রালী' জনপ্রিয়তার উচ্চ শিখরে
এবং উভয় পত্রিকায় কাজ করছেন তরুণ প্রতিভাবান একদল
লেখক ও সাংবাদিক। বন্ধুজনদের
উপস্থিত এবং দৈনন্দিন কাজের সুযোগের ভেতর দিয়ে
গ্রাফিক ডিজাইনের মধ্যে নিজেকে
মেলে দিচ্ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। এভাবে যেন ক্রমে
নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন তিনি।
কাইয়ুম চৌধুরী প্রস্তুতির সময় নিলেন অনেক বেশি,
কেননা নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ায়
তিনি কোনও সরল সমাধান কামনা করেননি। এই
বোঝাপড়ায় ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন
সংস্কৃতির নানা শাখায় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে এবং
ব্যবহারিক শিল্পের গভীর অনুশীলন
থেকে। আর ছিল পঠন-পাঠনে নিমজ্জিত থেকে রস আহরণের
চেষ্টা, গান ও সিনেমায় মজে
থাকা।
'অবজারভার' পত্রিকার রবিবারের সাময়িকীতে ডিজাইন
নিয়ে যেসব নিরীক্ষা করতেন তার
শিল্পগুণ শিক্ষক জয়নুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোনও এক
বিশেষ সংখ্যায় নৌকার গলুই,
ছই, নৌকার আকার ইত্যাদি যেভাবে ডিজাইনে ছেঁকে
তুলেছিলেন তিনি তা দেখে জয়নুল
আবেদিন শিল্পীর ভূয়সী প্রশংসা করে এই প্রচেষ্টা
ক্যানভাসে মূর্ত করার দিকে দৃষ্টি
আকর্ষণ করেন। জয়নুল আবেদিনের যা স্বভাব, তিনি
অনুজের শৈল্পিক স্বাধীনতায়
বিশ্বাসী এবং তাঁদের সামনে পথের ইশারা মেলে
ধরতেন, কোনও বিশেষ রীতিতে আবদ্ধ
করতে চাইতেন না। শিক্ষকের এই উত্সাহ তাঁর কাজে
বিশেষ প্রেরণা যোগায়। তখন
পেশার কাজের পরে সৃজনের প্রয়াসে একেবারে ডুবে
আছেন। তাঁর কাজে যে নানামুখিতা
ছিল, যার প্রতিফলন রয়েছে জলরং, তেলরং ও ছাপচিত্র
মাধ্যমের বিভিন্ন কাজে,
বিশেষভাবে ঘুরি হাতে বালক, আত্মপ্রকৃতি, বিড়াল
ইত্যাদি ছবিতে এর পাশাপাশি
লৌকিক শিল্পের ফর্মকে অবলম্বন করে বস্তু থেকে
নির্বস্তুতায় অথবা ডিজাইনে পৌঁছে
যাওয়ার লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল। জয়নুল আবেদিনের
উত্সাহ তাঁকে দেশজ রূপসম্পদের প্রতি
আরও মনোযোগী করে তোলে।
মৃত্যু
কাইয়ুম চৌধুরী ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর মৃত্যুবরণ
করেন।